জমি মানেই জম। গ্রামাঞ্চলের মানুষের মধ্যে এ ধরনের কুসংস্কার প্রায় লক্ষ করা যায়। তবে যারা জমি নিয়ে ঘাটাঘাটি করেন তাদের কাছে বিষয়টি তেমন জটিল বলে মনে হয় না। চলুন জেনে নেয়া যাক ভূমি উন্নয়ন কর : করণীয় বিষয়ে দরকারী কিছু বিষয়।
প্রাচীন কাল থেকেই কৃষকরা জমির খাজনা প্রদান করতেন। মাধ্যম ছিল অর্থ অথবা উৎপাদিত ফসল। ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত খাজনার সঙ্গে শিক্ষা খাতের জন্য টাকা আদায় করা হতো। ফলে ওই সময়ের শিক্ষিতরা গরীব কৃষকের টাকায় লেখাপড়া করেছেন-বলে দাবী করা হয়। ১৯৭৬ সালে ‘ভূমি উন্নয়ন কর অধ্যাদেশ’ এর মাধ্যমে খাজনা শব্দটি বাদ পড়ে যায়। বর্তমানে খাজনাই হলো- ভূমি উন্নয়ন কর। এতে অন্যকোন সেস বা আবওয়াব বা নজরানা আদায় করা হয়না। বাংলা সনের ভিত্তিতে ভূমি উন্নয়ন কর আদায় করা হয়। তিন বছর পর্যন্ত অগ্রিম ভূমি উন্নয়ন কর প্রদান করা যায়।
ভূমি উন্নয়ন কর কি?
কোনো জমি ভোগ দখলের সুবিধা গ্রহণের জন্য সরকারকে প্রতি শতাংশ জমির জন্য বছর ভিত্তিক যে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা প্রদান করতে হয় তাকেই ভূমি উন্নয়ন কর বলে। ভূমি উন্নয়ন কর দেয়ার পর দাতা দাখিলা পাওয়ার অধিকার লাভ করেন। দাখিলা দেয়া না হলে তা অধ্যাদেশের লংঘন হবে। এই দাখিলা জমির মালিকানা প্রমাণের গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
ভূমি উন্নয়ন কর বকেয়া হলে কি করবেন?
অনেকেরই ভূমি উন্নয়ন কর বকেয়া পড়ে থাকে। এক্ষেত্রে একটি ভুল ধারণা রয়েছে- তিন বছরের বেশি বকেয়া বাকী থাকলে তা আদায় করা যায়না। আসলে তা ঠিক নয়। বিধিমালা এ বিষয়টি স্পষ্ট করে দিয়েছে। তবে তিন বছরের মধ্যেই আদায়ের জন্য রেন্ট সার্টিফিকেট মামলা দায়ের করতে হয়। এই মামলার মাধ্যমেই জমি নিলামে বিক্রি করা হয়। কোন ক্রেতা পাওয়া না গেলে সরকার এক টাকা দিয়ে এ জমি কিনে খাসজমিতে পরিণত করে তা ভূমিহীনদের মধ্যে বন্দোবস্ত দিতে পারে। এ কারণে প্রতি বছরই ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করা উচিত। তবে বকেয়া পড়ে গেলে যেই বছর হতে কর বকেয়া রয়েছে তা ওই বছরের হার অনুযায়ী আদায় করতে হবে। এক্ষেত্রে ৬.২৫ ভাগ সুদ জ্যামিতিক হারে যোগ করতে হবে।
ভূমিকরের হার
বাংলা ১৩৭৮ সনে স্বাধীনতা অর্জিত হলে আগের অনাদায়ী সকল খাজনা মওকুফ করে বাংলা ১৩৭৯ সন থেকে খাজনা ধার্য করা হয়। বাংলা ১৩৮২ সন পর্যন্ত কোন পরিবারের ২৫ বিঘা বা ৮.২৫ একর এর উর্দ্ধে জমির জন্য খাজনা ও শিক্ষা কর ছিল। ২৫ বিঘার কম জমির জন্য শুধু শিক্ষা কর দিতে হতো।
বাংলা ১৩৮৩ সন (১৯৭৬ সাল) থেকে বাংলা ১৩৮৮ সন পর্যন্ত ২৫ বিঘা পর্যন্ত বিঘা প্রতি (৩৩ শতাংশ) এর জন্য ৯০ পয়সা এবং ২৫ বিঘার উর্দ্ধে বিঘা প্রতি ৫ টাকা খাজনা ছিল। বাংলা ১৩৮৯ সন থেকে বাংলা ১৩৯৩ সন পর্যন্ত ২ একর জমির জন্য শতাংশ প্রতি ৩ পয়সা, ২ একর থেকে ৫ একর পর্যন্ত জমির জন্য প্রথম দুই একরের জন্য ৬ টাকা এবং পরবর্তী প্রতি শতাংশের জন্য ১৫ পয়সা। ৫ একর থেকে ১০ একর পর্যন্ত জমির জন্য প্রথম ৫ একরের জন্য ৫১ টাকা এবং পরবর্তী প্রতি শতাংশের জন্য ৩৬ পয়সা। ১০ একর হতে ১৫ একর পর্যন্ত প্রথম ১০ একরের জন্য ২৩১ টাকা এবং পরবর্তী প্রতি শতাংশের জন্য ৬০ পয়সা। ১৫ একর থেকে ২৫ একর পর্যন্ত প্রথম ১৫ একরের জন্য ৫৩১ টাকা এবং পরবর্তী প্রতি শতাংশের জন্য ৬০ পয়সা। ২৫ একরের উপর হলে প্রথম ২৫ একরের জন্য ১৪৮১ টাকা এবং পরবর্তী প্রতি শতাংশের জন্য ১ টাকা ৪৫ পয়সা।
বাংলা ১৩৯৪ সন (১৯৮৭ সাল) থেকে বাংলা ১৪০১ সন (১৯৯৪ সাল) পর্যন্ত ২ একর জমির জন্য শতাংশ প্রতি ৩ পয়সা, সব মিলিয়ে এক টাকার কম নয়। ২ একর থেকে ৫ একর পর্যন্ত জমির জন্য শতাংশ প্রতি ৩০ পয়সা। ৫ একর থেকে ১০ একর পর্যন্ত শতাংশ প্রতি ৫০ পয়সা। ১০ একরের বেশি জমি হলে শতাংশ প্রতি ২ টাকা। বাংলা ১৩৯৮ সনের ১ বৈশাখ থেকে ২৫ বিঘা বা ৮.২৫ একর পর্যন্ত কৃষি জমির ওপর থেকে সকল ধরনের কর প্রত্যাহার করা হয়।
বর্তমানে প্রচলিত ভূমি উন্নয়ন করের হার
বর্তমানে বাংলা ১৪০২ সন থেকে ধার্য হার অনুযায়ী ভূমি উন্নয়ন কর আদায় করা হয়।
কৃষি জমির ক্ষেত্রে
২৫ বিঘা পর্যন্ত ভূমি উন্নয়ন কর মওকুফ। ২৫ বিঘার অধিক হতে ১০ একর পর্যন্ত জমির জন্য প্রতি শতাংশ জমির জন্য ৫০ পয়সা। ১০ একরের উর্দ্ধে হলে প্রতি শতাংশ ১ টাকা।
চা/রাবার/ফল/ফুলের বাগানের ক্ষেত্রে
চা বাগান, রাবার বাগান,আমবাগান অথবা ১ একরের উধ্বে কোনো জমিতে ফলের বাগান কিংবা ফুলের বাগান থাকলে জমির ক্ষেত্রে প্রতি শতাংশ জমির জন্য ১ টাকা ১০ পয়সা।
পল্লী এলাকার আবাসিক জমির ক্ষেত্রে
১৯৯০ সালের ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়েলের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পল্লী এলাকার বসবাসকারী কৃষি পরিবারের চাষের জমি এবং বসত বাড়ী কৃষি জমি হিসাবে গন্য করে কৃষি হারে ভূমি উন্নয়ন কর ধার্য হবে। তবে পল্লী এলাকার পাকা ভিটির বাড়ীর জন্য শতক প্রতি ৫ টাকা হারে কর দিতে হবে।
অকৃষি জমির ক্ষেত্রে
কৃষি জমি বাদে অন্যান্য সকল জমিই অকৃষি কাজে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে সংরক্ষিত রাখলে তা অকৃষি জমি বলে গণ্য হবে। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, বাজারের সকল জমি অকৃষি জমি। তাতে কৃষি কাজ করা হলেও। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, গাজীপুর ও নারায়নগঞ্জ মহানগরীর মত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার আবাসিক জমির কর শতক প্রতি ২২ টাকা, বাণিজ্যিক ১২৫ টাকা এবং জেলা সদরের আবাসিক জমির কর শতক প্রতি ৭ টাকা, বাণিজ্যিক ২২ টাকা এবং অন্যান্য সকল পৌর এলাকার আবাসিক জমির জন্য কর শতক প্রতি ৬ টাকা বাণিজ্যিক হার ১৭ টাকা। পৌরসভা ঘোষিত হয়নি এরূপ এলাকার আবাসিক পাকা ভিটি হার ৫ টাকা, বাণিজ্যিক ১৫ টাকা।
শিল্প বা বাণিজ্যিক এলাকার ক্ষেত্রে
শিল্প ও বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত ভূমির জন্য যে পরিমাণ জায়গা শিল্প/বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত হয় তার কর বাণিজ্যিক হারে হবে। আর যে পরিমাণ জমি আবাসিক কাজে ব্যবহৃত হবে তার খাজনা আবাসিক হারে হবে। বাংলা ১৪০২ সন থেকে অব্যবহৃত বা পতিত জমির কর কৃষি হারে (১ টাকা প্রতি শতাংশ) হবে। তার আগের কর বাণিজ্যিক হারে হবে।
ডেইরী ফার্ম/পোলট্রি পোলট্রি ফার্মের ক্ষেত্রে
কৃষি জমিতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গবাদি পশু পালন ও হাঁস মুরগি এর খামার স্থাপন করা হলে সেই জমির পরিমাণ যাই হোক বাণিজ্যিক হারে কর হবে। শহর, উপশহর, পৌরসভা ও উপজেলা সদরে অবস্থিত বসতবাড়ী সংলগ্ন অকৃষি জমিতে ডিম, দুধ ও মাংস উৎপাদনের লক্ষ্যে স্থাপিত খামারে দুগ্ধবতী গাভীর সংখ্যা অনধিক ১৫ টি হলে এবং হাঁস মুরগীর সংখ্যা অনধিক ৫০০ টি হলে উক্ত খামারের ভূমিকর আবাসিক হারে হবে। সরকারী/আধা সরকারী ও স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা কর্তৃক গবেষণামূলক কাজের অংশ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত খামারের জমির খাজনা আবাসিক হারে আদায় করতে হবে ৷যেকোন খামারে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে দুধ ও মাংস প্রক্রিয়াজাত করে বিপনন বা বিক্রির ব্যবস্থা করলে ভূমিকর বাণিজ্যিক হারে হবে। উল্লেখ্য যে এসব খামারের গোচারণ ভূমি বা হাঁস মুরগির খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত জমির কর আবাসিক হারে হবে ৷এছাড়া খেলার মাঠ, স্টেডিয়াম, সুইমিং পুল,শরীর চর্চা কেন্দ্র এবং সরকারী সকল ক্রীড়া চত্বরের কর আবাসিক হারে হবে।
হস্তচালিত তাঁত ঘরের ক্ষেত্রে
কোনো তাঁত ঘর তাতীর নিজস্ব বসতবাড়ীর অভ্যন্তরে বা গৃহসংলগ্ন হলে এবং তাঁতের সংখ্যা সর্বাধিক ৫টি হলে এবং তাঁতগুলি সম্পূর্ণ হস্তচালিত ও তাঁতীর নিজস্ব বা পরিবার ভুক্ত সদস্যের শ্রমে চালিত হয়ে থাকলে হস্তচালিত তাঁত শিল্প যে জমির উপর অবস্থিত উক্ত জমির কর আবাসিক হারে হবে। মজুরীর ভিত্তিতে বাইরের লোক নিয়োগ করলে অথবা শক্তিচালিত তাঁত ব্যবহার করলে বা তাঁতীর বসত বাড়ীর অংশ বিশেষে বাণিজ্যিক কার্যক্রম থাকলে ঐ জমির জন্য ভূমি উন্নয়ন কর বাণিজ্যিক হারে দিতে হবে।
পরিশোধের পদ্ধতি
ভূমি উন্নয়ন কর ১ বছরের বকেয়া হলে সংশ্লিষ্ট বাংলা সনের ৩০শে চৈত্রের পরই উক্ত কর বকেয়া বলে গন্য হবে এবং মূল পাওনাকৃত করের সাথে ৬.২৫ হারে সুদ যোগ হবে এবং যত বছরের কর বাকী থাকবে ততগুন সুদ বেশী হবে এবং মূল করের সাথে যুক্ত হবে ৷একজন কৃষি জমির মালিককে প্রতি বছরে ১০০ টাকা ভূমি উন্নয়ন কর দিতে হলে আর তা বাংলা ১৪১৬ সন হতে বাংলা ১৪২১ পর্যন্ত ৬ বছর যাবত বকেয়া থাকলে তাকে বর্তমানে কত টাকা খাজনা পরিশোধ করতে হবে? এখানে ৬ বছরের মধ্যে শেষ বছরটিকে তথা ১৪২১ সালকে হাল সন ধরে পূর্বের ৫ বছরের করের সাথে জ্যামিতিক হারে সুদ দিতে হবে।
সুতরাং ১০০ x ৬ = ৬০০ টাকা।
১৪২০ সাল বা ৫ম বছরের জন্য সুদ হবে = (১০০ x ৬.২৫% x ১) = ৬.২৫ টাকা।
১৪১৯ সাল বা ৪র্থ বছরের জন্য সুদ হবে = (১০০ x ৬.২৫% x ২) = ১২.৫০ টাকা।
১৪১৮ সাল বা ৩য় বছরের জন্য সুদ হবে = (১০০ x ৬.২৫% x ৩) = ১৮.৭৫ টাকা।
১৪১৭ সাল বা ২য় বছরের জন্য সুদ হবে = (১০০ x ৬.২৫% x ৪) = ২৫ টাকা।
১৪১৬ সাল বা ১ম বছরের জন্য সুদ হবে = (১০০ x ৬.২৫% x ৫) = ৩১.২৫ টাকা।
সুতরাং ৬ বছরের জন্য মোট (৬০০+৬.২৫+১২.৫০+১৮.৭৫+২৫+৩১.২৫)= ৬৯৩.৭৫ টাকা বকেয়া ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করতে হবে।
যেক্ষেত্রে ভূমি উন্নয়ন কর দিতে হয়না
(ক) ২৫ বিঘার কম জমি থাকলে ৷স্টেটমেন্টভূক্ত জমি ২৫ বিঘার কম হলেও কর দিতে হবে। তবে সহকারী কমিশনার (ভূমি) কর্তৃক বিবরণী ভাংগার আদেশ হলে ভূমি উন্নয়ন কর মওকুফ হবে।
(খ) ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষী পর্যায়ে নিজে শারীরিক পরিশ্রম করে হাঁস-মুরগীর খামার/ডেইরী ফার্ম হিসাবে কোন জমি ব্যবহার করলে। (০.৫০ হতে ১.৪৯ একর পর্যন্ত জমির মালিককে প্রান্তিক চাষী এবং ১.৫০ হতে ২.৪৯ একর পর্যন্ত জমির মালিককে ক্ষুদ্র চাষী বলা হয়)
(গ) ৫টির কম হস্তচালিত তাঁত জমির মালিক নিজে শারীরিক পরিশ্রম করে চালালে।
(ঘ) মসজিদ, ঈদগাহ, মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডা, কবরস্থান, শ্মশানঘাট এর ভূমি উন্নয়ন কর জেলা প্রশাসক মওকুফ করতে পারেন। এরজন্য তার কাছে আবেদন করতে হবে।
মওকুফ দাখিলা নিয়ে ভ্রান্তধারণা
২৫ বিঘা বা ৮.২৫ একরের কম জমির মালিকেরা ২ টাকার একটি মওকুফ দাখিলা পাবেন। একাধিক বছরের জন্য একটি মওকুফ দাখিলাই যথেষ্ঠ। মনে রাখতে হবে- একে ভূমি উন্নয়ন কর হিসাবে বিবেচনা করা হয়না। বিবিধ আদায় হিসাবে গণ্য হয়। এজন্য প্রতিবছর ২ টাকার মওকুফ দাখিলা সংগ্রহের প্রয়োজন নেই।
ভূমির বিবরণ দাখিলে বাধ্যবাধকতা
রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ত্ব আইন, ১৯৫০ এর ১৫১ ধারার ডি উপধারা অনুযায়ী কোনো কৃষি জমির মালিকের ২৫ বিঘার বেশী কৃষি জমির মালিক হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নির্ধারিত ফরমে সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর নিকট জমির বিবরণ দাখিল করতে বাধ্য থাকেন। আইনের ১৫১(ই) ধারা অনুযায়ী কোন ব্যক্তি ২৫ বিঘার বেশী কৃষি জমির মালিক হলে এবং উক্ত জমির বিবরনী দাখিল না করলে কিংবা ইচ্ছাকৃত ভাবে জমির তথ্য গোপন করলে তাকে ১০০০ টাকা জরিমানা দিতে হবে ৷১৫১ (এইচ) ধারা অনুযায়ী বিবরনী বহির্ভূত জমি সরকার বরাবরে বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে। কারো মালিকানায় ২৫ বিঘার বেশি সম্পত্তি রয়েছে মর্মে সন্দেহ হলে সহকারী কমিশনার (ভূমি) উক্ত আইনের ৭৪(১) ধারা অনুযায়ী বিবরণী দাখিলের জন্য নোটিশ দিতে পারেন। অবাধ্য হলে দন্ডবিধির ১৭৫ ও ১৭৬ ধারা অনুয়ায়ী দন্ডনীয় অপরাধে অপরাধী হবেন।
জমির বিবরণী কমিয়ে আনতে করণীয়
বিবরণী দাখিলকারীর মৃত্যু অথবা জমি বিক্রয়, দান ওয়াকফ ইত্যাদির ফলে অথবা কোনো ভাবে জমি হস্তান্তরের ফলে জমির পরিমাণ ২৫ বিঘার নীচে নেমে গেলে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ত্ব আইন, ১৯৫০ এর ১৫১ ধারার (আই) উপধারা মতে জমির মালিক অথবা তার উত্তরাধিকারীগণ সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর নিকট ২৫ বিঘা জমির বিবরণী কমিয়ে আনার জন্য তথা বিবরনী ভাংগার জন্য আবেদন করবেন। ১লা কার্তিকের পূর্বে আবেদন করতে হবে। উক্ত আবেদন পাবার পর সহকারী কমিশনার (ভূমি) প্রয়োজনীয় তদন্ত এবং শুনানীর ব্যবস্থা করে যথাযথ মনে করলে বিবরণী সংশোধন বা ভাংগার বা বিবরণী কমিয়ে আনার আদেশ দিবেন। আবেদনটি যদি মঞ্জুর হলে উক্ত আদেশটি ১লা কার্তিক হতে কার্যকর হয়। এজন্য পূর্বের বছরগুলোর করের সঙ্গে প্রথম ৬ মাসের কর পরিশোধ করতে হবে। আর কার্তিক মাসের পর আবেদন করলে চলমান পুরো বছরের কর পরিশোধ করতে হবে।
তবে জমির পরিমাণ ২৫ বিঘার নীচে নেমে গেলেও তা কর্তৃপক্ষকে না জানানো পর্যন্ত জমির মালিককে ভূমি উন্নয়ন কর বা খাজনা পূর্বের বিবরণী মোতাবেকই দিতে হবে। অনেক কৃষি জমির মালিকই কর মওকুফের সুবিধা লাভের আশায় প্রতারণামূলক জমি বন্টন করে জমি ২৫ বিঘার নীচে কমিয়ে আনলেও আইনগত ভাবে কর বা খাজনা মওকুফের সুবিধা পাওয়া যাবে না। বিবরণভুক্ত কোনো মালিকের জমি কেউ ক্রয় করলে ক্রেতাকে তার নিজের নামে উক্ত জমির নাম জারী করে আলাদা না করা পর্যন্ত ক্রেতাকে পূর্বের বিবরণী মোতাবেকই উক্ত জমির খাজনা প্রদান করতে হবে। উত্তারাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমির বিবরণী ভাংগতে হলে ওয়ারিশদের মধ্যে আপোষ বণ্টনপূর্বক তা রেজিস্ট্রি করে আবেদনের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। এছাড়াও বিবরণীভুক্ত জমি কেনার আগে ঐ জমির ভূমি উন্নয়ন কর বাকী আছে কিনা তা যাচাই করে নেয়া দরকার। এছাড়া বড় অংকের ভূমি উন্নয়ন করের সম্মুখীন হওয়াই স্বাভাবিক।
প্রতিকারের জন্য কোথায় যেতে হবে
বর্তমানে ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা বা তহশিলদার ভূমি উন্নয়ন কর আদায় করে থাকেন। আগেই বলা হয়েছে-এরা কোন অসৎ অর্জনের জন্য বেশি কর ধার্য করলে অথবা এতদসংক্রান্ত কোনো ব্যাপারে সমস্যা সৃষ্টি হলে সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। দাবী সম্পর্কে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) অথবা জেলা প্রশাসক এর কাছে ১৫ দিনের মধ্যে আপত্তি দাখিল করতে হবে। জেলা প্রশাসকের আদেশে কোনো ব্যক্তি সন্তুষ্ট না হলে সেই আদেশের বিরুদ্ধে ৪৫ দিনের মধ্যে বিভাগীয় কমিশনারের নিকট আপিল করা যাবে। বিভাগীয় কমিশনারের আদেশে কোন ব্যক্তি সন্তুষ্ট না হলে সেই আদেশের বিরূদ্ধেও ১৫ দিনের মধ্যে ভুমি আপিল বোর্ডের নিকট আপিল করা যাবে।
শেষ কথা
ভূমি উন্নয়ন কর নামেমাত্র। এরপরেও জমির মালিকরা ভূমি উন্নয়ন কর দিতে অনিচ্ছুক। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সারাদেশে ভূমি উন্নয়ন কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ হাজার ৭৯১ কোটি টাকা। রাজস্ব আয় হয়েছে মাত্র ৩৫৬ কোটি টাকা। ১ হাজার ৪৩৪ কোটি টাকা আদায় করা যায়নি। আমার কর্মস্থলে কিছু সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী লোকজনকে দেখেছি, তারা বছরের শুরুতেই ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করে দেন। তাদের বিশ্বাস খাজনা দেয়া না হলে জমিতে ফসল ফলেনা। তারা এক্ষেত্রে অনুকরনীয়। ভূমি কর প্রদানের অনীহায় সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পিছিয়ে নেই। ৩৫টি মন্ত্রণালয়ের কাছে ভূমি মন্ত্রণালয়ের ভূমি উন্নয়ন কর বকেয়া রয়েছে ১ হাজার ৩১৫ কোটি ৯৪ লাখ ১৯ হাজার ১০৩ টাকা। এছাড়া গত বছরের বকেয়া এবং চলতি অর্থবছরের পাওনা মিলে বকেয়ার পরিমান দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৪শ কোটি টাকা। এখনও ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির ভূমি উন্নয়ন কর মওকুফ। মওকুফের বিষয়টি আরেকটু ভাবা দরকার। কারণ সবার সামর্থ্য বেড়েছে। ২৫ বিঘা জমির মালিকদেরও করের আওতায় আনাটা এখন সময়ের দাবী। তাহলে লক্ষ্যমাত্রা ১০ হাজার কোটি ছাড়িয়ে যাবে। আর এতেই ভূমিতে উন্নয়নের ছোয়া লাগবে বলে আমার বিশ্বাস। সকল ভূমি করের আওতায় আসলে ভুমি বিরোধ, মালিকানাসহ অনেক বিষয়েরও সমাধান হয়ে যাবে। তবে সবাই ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করবেন- এটাই আমার প্রত্যাশা।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস